আপডেটের সময়ঃ সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২
‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ – এর মত অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার (৭৯) আর নেই।
কিংবদন্তি এই গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক রবিববার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এ গীতিকার, পরিচালকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার তালেশ্বর গ্রামে। ষাটের দশকে যখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র থাকাকালে গাজী মাজহারুল আনোয়ার লেখেন ‘বুঝেছি মনের বনে রঙ লেগেছে’। এটিই তাঁর প্রথম রচিত গান। সেই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন।
পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে সরকার ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়। ১৯৭২ সালে তিনি পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গানের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার। এরমধ্যে ৫-৬ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রুনা লায়লার গাওয়া প্রথম গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বল কি হবে’ গাজী মাজহারুল আনোয়ারেরই লেখা।
শুধু চলচ্চিত্রে নয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে টেলিভিশনের জন্যও নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানের জন্য গান লেখা শুরু করেন। সে সময় গানপ্রতি মিলতো ৫০ টাকা। সেই দিয়ে তার পেশাদার গীতিকারের জীবন শুরু। ১৯৬৫ সালে সুভাষ দত্তের আয়না ও অবশিষ্ট সিনেমায় তার ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি এখনো বাংলার আপামর মানুষ গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন।
১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা’ সিনেমার জন্য তাঁর লেখেন মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রেরণাদায়ী গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। আনোয়ার পারভেজের সুরে সেই গানকেই পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’ আর ‘একবার যেতে দে না’- এই তিনটি গান বিবিসির এক জরিপে ২০ শতকের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়।
গানের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষ ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। তাঁর পরিচালিত ও প্রযোজিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। এর মধ্যে রয়েছে শাস্তি, স্বাধীন, শর্ত, সমর, ক্ষুধা, তপস্যা, উল্কা, পরাধীন, পাষাণের প্রেম,জীবনের গল্প, এই যে দুনিয়া, অগ্নিশিখা, জিঞ্জির, আনারকলি, বিচারপতির মত সিনেমা।
গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, “গাজী মাজহারুল আনোয়ার তার সৃষ্টির মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছেন দেশের সংস্কৃতিকে। তার মৃত্যু দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বিশেষ করে সংগীতাঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।”
শোকাবিষ্ট শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “উনার মত কেউ ছিলেন না। আর এরকম মেধাবী মানুষ কেউ আসবেন কিনা জানি না। ভীষণ গুণী গীতিকার-গীতিকবি ছিলেন। অসংখ্য স্মৃতি উনার সাথে আমার।”
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বিখ্যাত গানের মধ্যে আছে- `এই মন তোমাকে দিলাম’ , ’গীতিময় সেইদিন চিরদিন’, ’ইশারায় শিষ দিয়ে’ , ’ছোট্ট একটি গ্রাম মধুমতি তার নাম’, ‘ফুল যদি ঝরে গিয়ে আজকে রাতে’ ‘ ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘চোখ যে মনের কথা বলে’, ‘নীল আকাশের নিচে’ সহ অজস্র স্রোতা প্রিয় গান।
সোমবার সকালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানাবে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনেও (বিএফডিসি) নেওয়া হবে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কফিন। জোহরের পর সেখানে জানাজা হবে। তারপর বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।#