আপডেটের সময়ঃ জানুয়ারি ৮, ২০২৩
ইমন কল্যাণ ঘোষ
এক সময় চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট শহর সহ দেশের সর্বত্র বাঘ বিচরণ করতো। এখন তা কমতে কমতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে গোটা কয়েক এবং বাকিগুলো সুন্দরবনে বিরাজমান। সর্বশেষ বাঘ শুমারীতে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর সংখ্যা বাংলাদেশ অংশে মাত্র ১১৪ টি।
চীন সহ বিশ্বের কিছু কিছু দেশে প্রচলিত চিকিৎসায় বাঘের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিশাল বাজার এখনো বিদ্যমান আছে। ফলে চোরাশিকারী, সৌখিন শিকারী এবং নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে বন বনানী পাহাড় ধ্বংসের কারণে মূলত বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
এক সময় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও রয়েলবেঙ্গল বসবাস করতো। গাজী আসমত ও এমএমএ হান্নান সম্পাদিত “বাংলাদেশের বন্যপ্রাণির তালিকা” হতে জানা যায় চট্টগ্রামে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, ডোরাকাটা বাঘ, সোনালি বাঘ, মর্মর বাঘ, লাল বাঘ, গেছো বাঘ, মেছো বাঘ, বনবিড়াল, ওয়াব, মোয়াব, খাটাস, বাঘদাশ, লাম চিতা ইত্যাদি বাঘ ও বড় প্রজাতির বিড়াল বাস করতো। গাজী আসমতের নিবন্ধ “বাংলাদেশের বন্যপ্রাণির দেড়শত বছরের আগের ইতিহাস” এবং জেলা গেজেটিয়ারেও একই তথ্য পাওয়া যায়।
হাজার বছরের চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানে ঘন বনবনানি, পাহাড়, টিলা, নদী, খাল-বিলে ভরা ছিল। এই প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ, বন্যপ্রাণিদের জন্য ছিল অভয়ারন্য।
প্রাচীন চট্টগ্রাম শহরে অসংখ্য বাঘের বসবাস এর কারণে এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরন করা হয়েছে বাঘকে ঘিরে। উদাহরণ স্বরূপ : বাঘঘোনা, টাইগার পাস, বাঘভেলি ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়। এমনকি দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি স্থানের নাম “বাঘগুজরা”। অর্থাৎ এখানে প্রাচীনকালে বাঘের গর্জন শোনা যেত।
বিশ্বের অন্য কোন শহরের কোন এলাকার নাম বাঘকেন্দ্রিক আছে কিনা তা অবশ্য জানা নেই। এলাকার নামকরন দেখেই বোঝা যায় যে, চট্টগ্রামে কি পরিমাণ বাঘ ছিল।
চট্টগ্রাম গবেষক “আবদুল হক চৌধুরী” এর তথ্য মতে থেকে চট্টেশ্বরী রোড, ওয়ার সিমেট্রি সন্নিহিত অঞ্চলে বাঘভেলু নামে একটি এলাকা অবস্থিত ছিল। কিন্তু “জুরিসডিকশন্ লিস্ট অব দ্য ডিস্ট্রিক চিটাগং- ১৯৩০ এ কোতোয়ালী থানার মৌজাসমূহে তার উল্লেখ নেই। তবে চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্টারের রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত দলিলপত্রের বালামে বাঘভেলু মৌজার সন্ধান পাওয়া যায়।
পূর্ণচন্দ্র চৌধুরীর “চট্টগ্রামের ইতিহাস” (১৯২০ সালে প্রকাশিত) গ্রন্থে বাঘ ভেলু এলাকার নাম লিপিবদ্ধ আছে। তার লেখা হতে জানা যায় যে, ঐ এলাকাটি সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা বা সমতল ভূমি। এই বাঘভেলি ছিল বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র। এখানে গভীর অরণ্য ছিল। মূলত টাইগার ভেলি বা বাঘ ভেলি স্থানীয়দের দ্বারা বাঘভেলু হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
জানা যায় যে, সে কালে কাঠুরেরা দলবদ্ধভাবে ছাড়া একাকী কাঠ, বাঁশ, ছন ইত্যাদি সংগ্রহে যেত না, শুধুমাত্র বাঘের ভয়ে। তৎকালীন চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীরা সর্বদা বাঘের আক্রমণের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতো।” ঐ সময় বাঘের উৎপাত বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার কতৃক বাঘ শিকারীদের পুরস্কৃত করা হতো।
তৎকালের চট্টগ্রামের কালেকটর এল ক্লে (১৮৬২ইং) লেখেন যে “একদিন দুপুরবেলা খোলা বাজারে বাঘের আক্রমণে একজন নেটিভ (স্থানীয় অধিবাসী) প্রাণ হারায়।
সে সময় চট্টগ্রামের জমজমাট বাজার ছিল চকবাজার, দেওয়ানবাজার এবং ফিরিঙ্গীবাজার। তবে চকবাজার ছিল সবচেয়ে বেশি জমজমাট। ক্লে সাহেবের অফিস চকবাজারের কাছাকাছি ছিল, হয়তো তিনি ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
ঐতিহাসিক “পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী” উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ফিরিঙ্গীবাজারে বাঘ কতৃক মানুষ মারার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। ব্রিটিশ সরকার প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কালে পাহাড়ে বাংলো নির্মাণ শুরু করেন। তারাই তখন তাদের সেনাবাহিনীকে নিরাপদ রাখার জন্য চট্টগ্রাম শহরের বনজঙ্গল পরিষ্কারের নামে বাঘ নিধন শুরু করেন।
১৯৪১-৪২ সালের দিকেও স্থানীয় প্রবর্তক সংঘ স্কুল এর হোস্টেল কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যার পর ছাত্রদের হোস্টেল থেকে বের হতে দিতেন না। কারণ বর্তমান মেডিকেল কলেজ, সার্সন রোড, চট্টেশ্বরী এলাকা জুড়ে ছিল পাহাড় আর ঘন বন জঙ্গল। সেখানে ছিল বাঘের বসতি।
“টাইগার পাস” চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। তার আশপাশ এলাকা পাহাড়বেষ্টিত। আজ থেকে শত শত বছর আগে ঐ এলাকা গভীর জঙ্গলে আবৃত ছিল। ছিল জনবসতিহীন। সেখানে দিনে দুপুরে বাঘ চলাচল করতো। চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার বাঘ এইপথে চলাচল করতো বলে ব্রিটিশরা এর নামকরণ করে গেছেন টাইগার পাস।
“লিভ্স ফ্রম এ ডায়রি ইন দ্য লোয়ার বেঙ্গঁল” থেকে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম তখন ছিল জঙ্গঁলাকীর্ণ। দিনদুপুরে বাঘের গর্জন শোনা যেত”। এতে বাঘের আক্রমণে মানুষ মৃত্যুর কথাও উল্লেখ করা আছে।
তৎসময়ে চট্টগ্রামের আর একটি এলাকার নাম ছিল “লেপার্ড পাস”। ক্লে সাহেবের বিবরণী থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। চিতাবাঘের উৎপাতের জন্য এ স্থানটি ছিল বিখ্যাত। বর্তমানে এ অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়ত কালের বিবর্তনে অন্য নাম নিয়েছে।
“বাঘঘোনা” নামে চট্টগ্রামে আর একটি স্থান আছে। লালখান বাজারের টিলা ও পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সমতল ভূমির নাম বাঘ ঘোনা। যা ঝাউতলা ওয়ারলেস কলোনী পর্যন্ত বিস্তৃত। বিংশ শতাব্দির তিন দশক পর্যন্ত এখানে ঘন জঙ্গলে আবৃত ছিল। এ এলাকায় বাঘ বিচরণ করতো বলে বাঘঘোনা নামে পরিচিতি পায় এলাকাটি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ঘোনা মানে বসতি।
পরিশেষে বলা যায়, চট্টগ্রামের শহর ও শহরতলী বনে জঙ্গলে একসময় বাঘের রাজত্ব ছিল। চট্টগ্রামের ইতিহাস লেখক, পর্যটক, গেজেটিয়ারে তথ্যে, স্মৃতি কথায় অন্তত তাই জানা যায়।
চট্টগ্রাম যেমন ব্যবসা বাণিজ্য, ধর্মপ্রচার, মগ, জলদস্যুতার জন্য বিখ্যাত। তেমনি এখানকার বন্যপ্রাণির জন্য বিশেষ করে বাঘের জন্য বিখ্যাত ছিল, যে ইতিহাস হয়ত অধিকাংশ চট্টগ্রামবাসীর অজানা।
বাঘঘোনা, টাইগার পাস, টাইগার হিল ইত্যাদি নাম চট্টগ্রামে বাঘের স্মৃতি বহন করে চলছে আবহমান কাল ধরে।
ইমন কল্যাণ ঘোষ – পরিবেশ-প্রকৃতি ও ভ্রমণ বিষয়ক লেখক