আপডেটের সময়ঃ ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২
দেশে-বিদেশে এখন বগুড়ার কৃষি ও হালকা প্রকৌশলশিল্পের ব্যাপক সুনাম। এই শিল্প খুব কম সময়ের মধ্যেই অনেক উদ্যোক্তার ভাগ্য বদলে দিয়েছে। কেউ কেউ শূন্য থেকে কোটিপতি ব্যবসায়ী হয়েছেন। তাঁদের কারখানা ও ওয়ার্কশপগুলোয় কর্মসংস্থান হয়েছে এক লাখের বেশি শ্রমিকের।
আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুফল পাচ্ছে অন্তত পাঁচ লাখ পরিবার।
উদ্যোক্তাদের সূত্রে জানা গেছে, দেশে কৃষি যন্ত্রপাতির বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করে বগুড়ার কারখানা ও ওয়ার্কশপগুলো, যার আর্থিক মূল্য এক হাজার কোটি টাকা। ফলে এসব যন্ত্রপাতির জন্য দেশের আমদানিনির্ভরতা কমেছে। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে এখানকার নানা যন্ত্রপাতি। তাঁরা বলেন, আগে ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি হতো। এখন দেশের আমদানি করা মোট যন্ত্রাংশের ৬০ শতাংশই আনেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
কামারশালা থেকে শুরু
বগুড়ায় কৃষি যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন ও হালকা প্রকৌশলশিল্পের শুরুটা হয়েছিল কার্যত কামারশালায় সারাইয়ের কাজ করা কয়েকজন কারিগরের হাত ধরে। তাঁরা গত শতকের চল্লিশের দশকে ছোট ছোট যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন ও তৈরির মধ্য দিয়ে ছোট্ট পরিসরে স্থানীয়ভাবে এ শিল্পের সূচনা করেন। কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, বগুড়ার কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের নেপথ্য কারিগরেরা যন্ত্রাংশের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে কামারশালায় লোহা পিটিয়ে বিকল যন্ত্র সারাতেন। এভাবে লোহা পিটিয়ে যন্ত্রাংশ তৈরি করতে করতেই তাঁরা একের পর এক কৃষি ও হালকা যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন করেন।
উদ্যোক্তারা জানান, তখন বৃহত্তর বগুড়া জেলায় পাকিস্তান ও জার্মানির তৈরি ধান ভাঙানোর যন্ত্র ব্যবহার হতো। ওই সব যন্ত্র বিকল হলে মেরামতের জন্য কলকাতার যজ্ঞেশ্বর কোম্পানিতে নিয়ে যেতে হতো। অথবা কলকাতা কিংবা ঢাকা থেকে কারিগর নিয়ে আসা হতো। এসব কারিগরেরা আবার বিকল যন্ত্রের ছোট ছোট যন্ত্রাংশ বানিয়ে নিতে আসতেন কামারশালাগুলোতে। কামারেরাও আগ্রহ নিয়ে যন্ত্রাংশ তৈরি করে দিতেন। এরই মধ্যে ষাটের দশকে সেচযন্ত্র চলে আসে দেশে। এই যন্ত্র বিকল হলেও সারানোর জন্য আনা হতো বগুড়ার কামারশালায়।
সত্তর দশকে কামারশালায় সেচযন্ত্রের ছোট যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু হয়। এ সময় কয়েকজন কারিগর একের পর এক কৃষি যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন করতে থাকেন। আশির দশকে নানা ধরনের হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন দ্রুত বাড়তে থাকে।
প্রথম দিকে অল্প কয়েকজন কারিগর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন শুরু করেন। তাঁদের পরে বেশ কিছু কৃষি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন মো. আমির হোসেন। তিনি বলেন, ষাটের দশকে শহরের নিউমার্কেট পুকুরপাড়ে ছিল ধলু কারিগরের কামারশালা, রেলগেটে ছিল আফসার মিয়া নামে একজনের ছোট ওয়ার্কশপ ও ঠনঠনিয়ায় ছিল মজিবর রহমান নামের আরেক কারিগরের দোকান।
একসময় দেশে জার্মানি ও ইংল্যান্ডের তৈরি লেদ মেশিন আসে। এই লেদে শুধু যন্ত্র মেরামত হতো। এরই মধ্যে ধলু কারিগর উদ্ভাবন করেন হস্তচালিত লেদ। ১৯৭৮ সালে কাঠের কাঠামো দিয়ে তিনি প্রথম পানির সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প উদ্ভাবন করেন। এতে যেন বিপ্লব ঘটে যায়।
উদ্যোক্তারা জানান, নব্বইর দশক থেকে ধলু কারিগরের ছেলে মো. আমির হোসেন একাধারে ইট ভাঙা ও ইট তৈরি; সেমাই, মুরগি ও মাছের খাদ্য, ভুট্টা মাড়াই, প্লাস্টিক পাইপ, গো-খাদ্য এবং পামতেল ও পাটের ছাল ছাড়ানোর যন্ত্রগুলো উদ্ভাবন করেন। একই সময়ে আজিজার রহমানসহ আরও কয়েকজন উদ্যোক্তা স্বল্প পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। তাঁরা বেশ সফল হন। বগুড়ার কৃষি ও হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতির ব্যবসায়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে যায়। অল্প সময়েই তাঁরা কোটিপতি ব্যবসায়ীতে পরিণত হন।
দুই হাজার রকমের পণ্য উৎপাদন
বগুড়ায় এখন কৃষি যন্ত্রাংশের ৫০০টি ওয়ার্কশপ, হালকা প্রকৌশল পণ্য তৈরির ৫০০ এবং ফাউন্ড্রিশিল্পের ১২৪টি কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ওয়ার্কশপ আছে কয়েক হাজার।
বগুড়া শহর ও শহরতলির আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি সরেজমিনে এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বড় কারখানার পাশাপাশি ছোট ছোট লেদ ওয়ার্কশপে দিন-রাতে যন্ত্রাংশ তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কারিগরেরা। কারখানা ও ওয়ার্কশপগুলো ঘিরে শহরের গোহাইল সড়ক, স্টেশন সড়ক ও বিআরটিসি মার্কেটে গড়ে উঠেছে কৃষি যন্ত্রাংশ ব্যবসার এক বিশাল বাজার।
সেন্ট্রিফিউগল পাম্প, সেচপাম্প, টিউবওয়েলসহ বগুড়ায় দুই হাজার রকমের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে পিটি চেন কভার, পিটি পুলি, ডি পুলি, ফুয়েল কি, ফুয়েল পাইপ, অয়েল ক্যাচার, টেনশন সেট, হাউজিং ফুয়েল ট্যাংক, ফুয়েল ফিল্টার, পাম্প, অয়েল সিল, এয়ার ক্লিনার, সাইলেন্সার, চেইন কভার ইত্যাদি। এসব পণ্যের মান বেশ উন্নত ও টেকসই বলে দাবি উদ্যোক্তাদের।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল মেশিনারিজ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলহাজ শেখ বলেন, হাজারখানেক কৃষি ও হালকা প্রকৌশলশিল্প গড়ে উঠলেও তা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। তাই শিল্পটি একসময় অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে। সে জন্য যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি আলাদা কৃষি শিল্পনগর গড়ে তোলা দরকার।
বিসিক শিল্পনগর
লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং বা হালকা প্রকৌশল খাতকে বলা হয় ‘মাদার অব ইন্ডাস্ট্রি’। কেননা হালকা প্রকৌশল খাতে সব ভারী শিল্পের প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল উৎপাদিত হয়।
বগুড়ার বিসিক শিল্পনগরে বর্তমানে চালু ৮৭টি শিল্প প্লটের মধ্যে ৭১টিতেই গড়ে উঠেছে কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশল শিল্পকারখানা। এর মধ্যে নয়টি ফাউন্ড্রি কারখানায় তৈরি হচ্ছে সেচপাম্প ও টিউবওয়েলের মতো পণ্য। আর ৬২টি কারখানায় তৈরি হয় কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশল পণ্য। প্রধান কাঁচামালগুলো হচ্ছে পুরোনো লোহালক্কড় (ভাঙারি লোহা), জাহাজভাঙার ও ঢালাই লোহা (পিগ আয়রন), সিলিকন পাত, কয়লা (হার্ডকোক) ও ফার্নেস তেল।
সংকটে এখন উদ্যোক্তারা
গুঞ্জন মেটাল ওয়ার্কসের চেয়ারম্যান অনিন্দিতা হক বলেন, সব ধরনের কাঁচামালের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ-সংকটে সম্ভাবনাময় এ শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ব্যাংকঋণ নিয়ে বিরাজমান সংকটের সমাধান করতে হবে।
বগুড়া চেম্বারের সহসভাপতি মাফুজুল ইসলাম বলেন, বিদেশি যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এখানকার সম্ভাবনাময় এ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে। এটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ আনতে হবে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক বলেন, বগুড়ার কৃষি যন্ত্র ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের সম্প্রসারণ ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সব সহযোগিতা দেওয়া হবে। এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রক্রিয়াধীন। সেখানে কৃষি শিল্পকারখানা স্থাপনে উদ্যোক্তারা সুযোগ পাবেন।
বিশ্ববাজারে বগুড়ার কৃষিযন্ত্র
বগুড়ার কৃষি ও হালকা প্রকৌশলশিল্প বিদেশেও বাজার সৃষ্টি করছে। এখানকার তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি, হালকা প্রকৌশলপণ্য ও ফাউন্ড্রিশিল্প বিদেশের বাজারে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
১৯৯৫ সালে ভারতে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প রপ্তানির মধ্য দিয়ে বিদেশের বাজারে প্রবেশ করে বগুড়ার কৃষিশিল্প। এরপর কয়েক বছর ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান প্রভৃতি দেশে সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, টিউবওয়েল, পানির পাম্প, ধানমাড়াইয়ের যন্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি রপ্তানি হয়। গত বছর এখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতে ১ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করে।
বিদেশি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ
স্থানীয় শিল্পমালিকেরা জানান, কয়েক বছর আগে বেলারুশ বগুড়ায় ট্রাক্টর, কম্বাইন হারভেস্টার, পাওয়ার টিলারসহ বিশ্বমানের বিভিন্ন ধরনের কৃষিযন্ত্র উৎপাদনে আগ্রহ দেখায়। তুরস্কের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলও যৌথ বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে। ভুটানের একটি প্রতিনিধিদল এসে এখানকার শিল্পবিপ্লব দেখে অভিভূত হয়। নেপালের পছন্দ এখানকার টিউবওয়েল।
এ ছাড়া ভারতের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিভিএস বগুড়ার উদ্যোক্তা আমির হোসেনের উদ্ভাবিত জ্বালানিবিহীন গাড়ি বাজারজাতকরণের প্রস্তাব দেয়। ইতালি ও সুইজারল্যান্ডও জ্বালানিবিহীন গাড়ি এবং মালয়েশিয়া আমিরের উদ্ভাবিত পাম তেলের যন্ত্র বিপণনে আগ্রহ দেখায়। এসব বিবেচনায় উদ্যোক্তারা রপ্তানি ও নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে বগুড়ায় একটি বিমানবন্দর গড়ে তোলার দাবি জানান।