মুখাবয়ব আর যাপনে জেলেদের গান


এখন চট্টগ্রাম ডেস্ক।

আপডেটের সময়ঃ ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২২

বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ আর বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শিল্পীদের একটি বড় ভূমিকা থাকে। যার মাধ্যমে শিল্পীরা সমাজ–সচেতনতার মধ্য দিয়ে নিজের বেড়ে ওঠা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে তুলে ধরেন রং-তুলির ছোঁয়ায়। ক্যানভাসে অনায়াসে রচিত হয় স্মৃতির গল্প।

শিল্পী মং মং সো, যিনি না–বোঝার বয়স থেকেই মাছের গন্ধ, মাছ ধরা, নদীর কাঁদা, নৌকা চালিয়ে নদী পার হওয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। যাঁর সকাল শুরু হয় বাংলাদেশের একটি দ্বীপ, মূল ভূখণ্ডের খুব কাছে ‘মহেশখালী’খ্যাত রাখাইনপাড়ায়। এখানকার মানুষ যেমন অমায়িক, মিতভাষী, অতিথিপরায়ণ; অন্য দিকে আনন্দ ও কষ্টে কাঁধে কাঁধ আর হাতে হাত রেখে ঐক্যবদ্ধ থেকে যেকোনো অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য রয়েছে নিরন্তর ভালোবাসা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে চীনের শিক্ষাজীবনে শিক্ষকদের সান্নিধ্যে তাঁর শিল্পসম্ভার গুছিয়ে নেওয়া। দূরপ্রান্তে থেকেও নিজের শিকড় ও জীবন-জীবিকার বিষয় তুলে ধরার নিরন্তর প্রয়াস পাই শিল্পীর কাজে। বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজের জড়িয়ে থাকা ও বড় হওয়ার ক্ষেত্রে একটি অদ্ভুত মিল রয়েছে। যেটা তাঁর কাজে এনেছে ভিন্নমাত্রা।

গাছের বিশাল কাণ্ড দিয়ে নৌকা তৈরি হচ্ছে। নৌকার আকার-আকৃতি, ভলিউম যেন প্রাণশক্তির আধার। কাজের পদ্ধতিগত মাধ্যমে কালেকটিভনেস ও টুগেদারনেসের একটি সমন্বয় পাওয়া যায়। পরিবেশ, প্রকৃতি ও এর উপাদানের বাইরে না গিয়ে বেড়ে ওঠার আদ্যোপান্ত তাঁর কাজের উপকরণে রয়েছে।

প্রথম দিকে মাছ ধরার ট্রলার, মাছ ধরার সব বিষয় নিয়ে কাজ করলেও পরবর্তী সময়ে শিল্পীর ভাবনা এবং কাজের জায়গায় এসে তার কিছুটা স্থান পরিবর্তন করেছে। শুধু নৌকা নিয়ে কাজ করলেও এবার নৌকার মধ্য দিয়ে নৌকার সঙ্গে জড়িত মানুষদের প্রতিকৃতি এঁকেছেন। সবাই যে মাছ ধরা পেশায় সম্পৃক্ত তা নয়। কেউ জেলে, কেউ ক্রেতা, কেউ মাছ ধরার শ্রমিক; আবার কেউ নৌকা চালিয়ে সমুদ্রে যাচ্ছেন মাছ ধরার জন্য। সমুদ্রে মাসের পর মাস থাকার পর কখনো তাঁদের খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে; যে কষ্ট আর খরচ করে মাছ ধরতে যাওয়া, সেটিও উঠে আসে না। অনেক সময় দুই-তিন মাসের জন্য শুকনা খাবার, টিকে থাকার জন্য প্রস্তুতি ও সংগ্রাম—এ সবকিছুই যেন ছোট ছোট গল্পে রূপ নিয়েছে আলাদা আলাদা চিত্রায়ণে। প্রত্যেক মানুষের মুখাবয়ব ভিন্ন, আলাদা চরিত্র, আলাদা অভিব্যক্তি, আলাদা পছন্দ, ভালো লাগা, আবেগ আর গায়ের রং ও মুখের গড়ন ভিন্ন। তাই শিল্পকর্মে শিল্পীর উপস্খাপিত মানুষ এবং তাদের ক্লান্ত–শ্রান্ত মুখাবয়ব প্রতিভাত হয়। রোদে পোড়া চামড়া, পাশেই লবণের চাষ, দীর্ঘসময় ধরে লবণাক্ত আদ্র৴ পরিবেশে লবণ চাষিদের শারীরিকভাবে কেমন বিপর্যস্ত করে, তা সরাসরি না দেখে প্রকাশ করা কঠিন। এককথায় প্রতিকূল আবহাওয়ায় থাকতে থাকতে জেলেদের চেহারা কালচে রং ধারণ করে। শ্রমের কাঠিন্য তাদের চেহারার সৌন্দর্য আস্তে আস্তে ম্লান করে দেয়, মুখমণ্ডলে দেখা দেয় মেছতা ও ব্রণ। এর প্রকাশ পাই শিল্পীর সম্প্রতি ‘সংগ্স অব ফিশারম্যান’ সিরিজের কাজে। শিল্পী তাঁর অভিব্যক্তি আর অভিজ্ঞতার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন পুরো কাজের শৈল্পিক প্রকাশে।

কাজের পদ্ধতিগত উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। জেলেদের সঙ্গে যে জালের সম্পর্ক, তার ব্যবহার পাই প্রেস মেশিনের সাহায্যে জেলেদের মুখাবয়বের ওপর জালের ছাপ ব্যবহারে। এতে এসব মানুষের কষ্ট জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে। এক্সপ্রেসিভ কোয়ালিটি তাঁর কাজে পাওয়া যায়, যা সম্পূর্ণ আলাদা আবেদন তৈরি করেছে। বিশাল নৌকায় জীবনযাত্রার ড্রয়িং কালো কালিতে তুলে ধরেছেন তিনি, সঙ্গে সারি বাঁধা জেলেদের মুখাবয়ব এবং নৌকার বিভিন্ন অংশের চিত্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা এবং হরাইজন্টাল ভাবে সাজানো মুখাবয়ব যেন সমুদ্রের দিগন্তের প্রকাশ। প্রত্যেকটি মুখাবয়বের ব্যাকগ্রাউন্ড কালার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে লাল রং। লাল সব সময়ই শক্তির আধার। এই রং অন্য রকম একটি মাত্রা প্রকাশ করে।

অনেক বেশি সাহসী না হলে লাল রং ধারণ করা যায় না। জেলেদের সেই সাহস, উদ্দীপনা ও জীবনযাপনে টিকে থাকার লড়াইকে শিল্পী লাল রঙে প্রতীকায়িত করেছেন। রোদ, বৃষ্টি ও সমুদ্রের ঢেউয়ের স্রোতের সঙ্গে নিজেকে টিকিয়ে রাখার মতো মানুষই মূলত যোদ্ধা। সবশেষে পুরো কাজের ইনস্টলেশনে ত্রিমাত্রিকতা এনেছে মাছ ধরার জালের ব্যবহার।

বিশাল পরিসরের এ সিরিজের গল্পগুলো মূলত জেলেদের জীবনের প্রতিটি উপাদান তুলে আনার প্রয়াস। জেলে ও মাঝি–মাল্লার চোখেমুখে প্রতিবিম্বিত হওয়া জীবনের ছবিগুলোই এখানে উঠে এসেছে। জেলেরা জলের সঙ্গে বাস করে তাদের যে কষ্ট, রোদে পোড়া চেহারা আর ত্যাগের সমীকরণ, তারই বহিঃপ্রকাশ শিল্পীর এই কাজ। প্রায় তেষট্টিটি জেলে মুখাবয়বসহ মোট সত্তরটি অংশের সমন্বয়ে ১১ ফুট বাই ৫৬ ফুট সাইজের এই শিল্পকর্মে শিল্পী পুরো জেলেজীবন তুলে ধরেছেন।

লেখক: সুস্মিতা বড়ুয়া, স্বাধীন গবেষক, শিল্প–সমালোচক