আপডেটের সময়ঃ অক্টোবর ১১, ২০২২
`রাগ রাফি-ভৈরবী-যোগ-বেহাগ-মাঝখাম্বাজ’ এর সুরের রস আস্বাদন করল নবীনগরের শ্রোতৃবর্গ। এই প্রথম সুরের দেশের মহান রাজা বাবা আলাউদ্দিনের দেশে রাগ সংগীতের সমারোহ হল। যার হাত ধরে এই প্রথম সুর-সমারোহের কর্মযজ্ঞ ঘটল তিনি একজন জনপ্রশাসনের উদ্যমী অফিসার, নবীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার একরামুল ছিদ্দিক।
সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর ১৬০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় নবীনগর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ০৮ অক্টোবর ২০২২ তারিখ শনিবার নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে কেককাটা, সুরসম্রাটের ‘সংগীত সাধনা’ বিষয়ে রচনা প্রতিযোগিতা, জীবনীর উপর কুইজ প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা ও শাস্ত্রীয় সংগীতানুষ্ঠান।
নবীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর সভাপতিত্বে আলোচনা পর্বে বক্তব্য রাখেন সুরসাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের পুত্র ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সুরকার শেখ সাদী খান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ মোশারফ হোসাইন, উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয়চন্দ্র সাহা, নবীনগর প্রেসক্লাবের সভাপতি জালাল উদ্দিন মনির, নবীনগর উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি আবু কামাল খন্দকার, এবং সামাজিক সংগঠন ‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’ এর পরিচালক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল।
নজরুল ও উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি কর্তৃক অংকিত বাবা আলাউদ্দিন খাঁ এর একটি স্কেচ (ছবি) উপজেলা নির্বাহী অফিসার এর নিকট হস্তান্তর করেন এবং একটি বাবা আলাউদ্দিন এর স্মৃতি সংরক্ষণার্থে একটি তথ্যবহুল মিউজিয়াম তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে অনুরোধ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার একরামুল ছিদ্দিক বলেন, “বিশ্ববরেণ্য সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর জন্ম এই নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে। নবীনগর উপজেলায় ইউএনও হিসাবে যোগদানের পর-পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পারি শিবপুরে ওস্তাদজীর পিতা-মাতার সমাধিস্থল অযত্ন-অবহেলায় এবং অরক্ষিতভাবে পড়ে আছে। আমি তৎক্ষণাৎ ওস্তাদজির শিবপুরস্থ ওস্তাদজীর স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থান পরিদর্শন করে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করি। ইতোমধ্যে ওস্তাদজীর পিতা- সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সধু খাঁ, মাতা- সুন্দরী বেগম এবং ছোট বোনের সমাধিস্থলে এস এস গ্রীল ও গেইট সংযোজন রং ও টাইলসকরণ করে একটি স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া সুরসম্রাট ডিগ্রী কলেজ প্রাঙ্গনে সুরসম্রাটের জীবনীসহ একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে সুরসম্রাটের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে একটি স্থায়ী পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কমপ্লেক্স হলে শিবপুর একটি তীর্থ এবং পর্যটন স্থান হিসাবে আত্মপ্রকাশ হবে। এবারই প্রথম উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সুরসম্রাটকে নিয়ে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রথম শাস্ত্রীয় সংগীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা রাখছি”।
অনুষ্ঠানের অন্তিমপর্ব শুরু হয় কণ্ঠ-যন্ত্রে রাগ সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। শুরুতে খেয়াল ও ঠুমরি পরিবেশন করেন শিল্পী করিম হাসান খান। তাঁর সাথে তবলায় সাথ-সঙ্গত করেন শিল্পী গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু। বিলম্বিত একতাল ও ত্রিতাল মধ্যলয়ে রাগ যোগ পরিবেশন করেন শিল্পী বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি। পরে তিনি মিশ্র মাঝখাম্বাজ এর উপর ঠুমরি পরিবশন করেন। তবলায় সঙ্গত করেন শিল্পী জাকির হোসেন। প্রাক্তন কোলকাতা উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী মমতাজ বেগম দুটি ঠুমরি পরিবেশন করেন। সেতারে তিনতারে রাগ কাফির সুরের অনুরণ তুলেন বর্ষীয়ান সেতারশিল্পী সত্যজিৎ চক্রবর্ত্তী। তিনি আওচার দিয়ে রাগের রূপবিন্যাস অংকন করে মধ্যলয় আর্দা তিনতালে গৎ এ ঢুকে দ্রুতলয়ে ঝালা দিয়ে তাঁর পরিবেশনা সমাপন করেন। তাঁর সাথে তবলায় সহযোগী ছিলেন শিল্পী জাকির হোসেন। সরোদ-সেতারে রাগ ভৈরবী পরিবেশন করেন শিল্পী আফসানা খানম ও শিল্পী রুখসানা খানম। তবলায় ছিলেন শিল্পী জাকির হোসেন এবং শিল্পী সঞ্জীব মজুমদার। চট্টগ্রামের শিল্পী রাজীব দাশের রাগ বেহাগ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শাস্ত্রীয় সংগীতানুষ্ঠানের যবনিকাপাত হয়। তিনি বিলম্বিত একতাল ও ত্রিতাল মধ্যলয়ে বেহাগের পকড়-মীড়-গমক এর স্বার্থক রূপবিন্যাস তাঁর পরিবেশনায় ফুটে তুলেন। সাবলীল তান-সরগম এবং আলাপের পুকার উপস্থিত দর্শকবর্গকে বিমোহিত করেন। সেইসাথে চট্টগ্রামের আরেক শিল্পী সুরজিৎ সেন এর শ্রুতিমধুর তবলা বোল থেকে সৃষ্ট নিনাদের এক অপরূপ সুরমুর্ছনা তৈরি হয়।
এই আয়োজন নান্দনিকতায় ভরপুর ছিল। সুসজ্জিত তোরণ, প্রচলিত সাউন্ড সিস্টেমের পাশাপাশি চারটি মাইক এর ব্যবহার, ত্রিডি ব্যানারে সুরসম্রাটের প্রতিকৃতি বসানো এই আয়োজনের বিশেষ আকর্ষণ। বাবা আলাউদ্দিন কে নিয়মিত শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর হোক এমনটাই প্রত্যাশা করেন উপস্থিত শ্রোতৃবর্গ।#