বিবাহ বিচ্ছেদ: দায় কেবল নারীরই?


এখন চট্টগ্রাম ডেস্ক।

আপডেটের সময়ঃ ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২২

আমাদের দেশের শহর এবং গ্রামাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা দ্রুতই বেড়ে চলেছে। এটি পারিবারিক-সামাজিকভাবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং স্পর্শকাতর বিষয় হলেও, সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠ আলোচনার পরিবেশ তৈরি করার। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া না হলে বিবাহবিচ্ছেদ হতেই পারে ! তবে একাধিক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের পরবর্তী সময়ে নানাকারণে নারীদেরকে পুরুষের তুলনায় বেশি ট্রমার মুখে পড়তে হয় বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা।
প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লেখ্য যে, আমাদের সমাজ নারীবান্ধব নয়, এমনকি নয় মানববান্ধবও। ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে সব দায় যেন নারীরই, এমনই মনে করা হয়। তালাক বা ডিভোর্সের পর সমাজ থেকে একজন নারীকে বলা হয়, ‘তোমার উচিত ছিল আরো একটু মানিয়ে চলা। বিবাহিত জীবনে এমন তো হতেই পারে।’ এক্ষেত্রে নারীটিকেই অনেক বেশি দোষারোপ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংসার ভাঙার পুরো দায়টা চাপানোর চেষ্টা করা হয় নারীর ওপর। এক্ষেত্রে নারীদের মানসিক অবস্থা সমাজ বোঝার চেষ্টা করে না। তালাকের পর সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে ট্রমা বা প্রবল মানসিক আঘাতের মুখে পড়েন নারীরা। একদিকে ঘর ভাঙার বেদনা, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা নারীদের মধ্যে চরম অনিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। একদিকে তার সংসার ভাঙায় একটা ব্যর্থতার মনোভাব যেমন কাজ করে, তেমনি আত্মবিশ্বাসও কমে যায়।
তালাকের পর যে মানসিক ট্রমা তৈরি হয় সেটা থেকে বের হতে অনেকের দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এটা অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে ওই ব্যক্তি মানসিকভাবে কতটা দৃঢ় তার উপর। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ থাকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। কারণ সামাজিকভাবে লিঙ্গগত দিক থেকে পুরুষের তুলনায় নারীদেরকে কম ক্ষমতাসম্পন্ন ভাবার প্রবণতা রয়েছে। এসব কারণেই পুরুষ আর নারীর ওপর তালাকের প্রভাব ভিন্ন হয়। এবং এই চিত্র কেবল বাংলাদেশের নারীদের প্রসঙ্গেই নয়, বরং সারা পৃথিবী জুড়েই তালাকের প্রভাব পুরুষের তুলনায় নারীদের ওপর বেশি পড়ে। কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থাই তাদেরকে অন্যের উপর নির্ভরশীল করে তোলে, সেরূপেই দেখতে চায়। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় অর্থনীতির ‘ফেমিনাইজেশন অব পোভার্ট’-র কথা। সেখানে সূচক টেনে দেখানো হচ্ছে নারীরা হচ্ছে দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম। ফলে যদি তারা অর্থনৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে প্রভাবশালী না হন তাহলে পুরুষের তুলনায় নারীর উপর তালাকের প্রভাব নেতিবাচক হবেই।

আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় মুসলিম পারিবারিক আইনটি আবারও একটু জেনে নেই। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, তালাকের আবেদন যে-ই করুক না কেন, সেটি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে অন্তত তিন মাসের ভরণ-পোষণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। অনেকেই মনে করে যে, তালাক হলেই দেনমোহর দিতে হবে। কিন্তু দেনমোহর আসলে তালাকের সাথে নয় বরং বিবাহের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিবাহের সময়েই সেটা পরিশোধ করতে হয়। ভরণপোষণের বিষয়টি হবে স্বামীর সাথে থাকার সময় ওই নারী যেমন জীবন-যাপন করতো ঠিক তেমন খরচই তাকে দেওয়ার বিধান রয়েছে। তালাকপ্রাপ্ত নারীর যদি কোন সন্তান থাকে তাহলে তার ১৮-বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত ওই সন্তানের সব ধরনের ভরণ-পোষণ দিতে হবে স্বামীকে। স্বামী যদি এই খরচ দিতে না চায় বা অসম্মতি জানায় তাহলে পারিবারিক আদালতে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। গবেষণার স্বার্থে যেসকল তালাকপ্রাপ্ত নারীদের সাথে কথা হয়েছে, তাদের প্রায় সকলেই তালাকের বিষয়টিকে নিজের তো বটেই, পরিবারের জন্যও অসম্মানজনক মনে করে থাকেন। সেসব কারণে তালাক নিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখ খুলতে চান না তারা। পারলে লুকিয়ে রাখা হয় পুরো বিষয়টিকে। যার কারণে তালাক সমাজে এক ধরনের ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে।
এই লেখাটির ইতি টানব একটি বিষয়ের দিকে আলোকপাত করে। বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক, তা পুরুষ বা নারী- যার মর্জিতেই হোক না কেন, যে-ই দিক না কেন, বিবাহবিচ্ছেদে আসলে কেউ জেতে না। বিবাহ বিচ্ছেদের অর্থ এটাই যে স্বামী-স্ত্রী একটি সম্পর্ক রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, হেরে গেছেন। এই হারের দায়িত্ব দু’জনেরই। তাই দু’জনেরই থাকতে হবে এই হারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার, সমঅধিকার, তা তাঁরা যে-ধর্মেরই হোন না কেন।