দুই নারী


এখন চট্টগ্রাম ডেস্ক।

আপডেটের সময়ঃ ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২২

মানুষটা যেদিন চোখ বোজে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাহেলা। বাড়িভরা লোকজনের ভাবনার শেষ নেই; পাঁচ পাঁচটি নাবালক ছেলেমেয়ে নিয়ে কেমন করে বাকী জীবন কাটাবে সে! আজও তিরিশের কোঠা পেরোয়নি। পুরো জীবন তো পড়েই আছে। রাহেলা নির্বিকার, নির্লিপ্ত। ঠিক তা নয়; ঠিক যেন নির্ভার, মুক্তস্বাধীন। পনের বছরের সংসারে মানুষটা তাঁকে পাঁচটা শিশু ছাড়া আর কিছুই দেয়নি; না সম্মান, না স্বস্তি। শিশুদের মুখ দেখে আনন্দ হয়েছে বৈকি। অসম্মান, বঞ্চনার তোড়ে ভেসে গেছে সব। এমন কোন বন্ধু ছিল না যাকে প্রাণ খুলে বলা যায় মনের কথা। মা বুঝত। ইশারায় কেবল বলত- মানিয়ে নে, আমি নিয়েছি না…। না, নিজের বাবাকে এতোটা খারাপ মনে হয়নি, এই মানুষটার মতো। মনে মনে মুক্তি কামনা করত রাহেলা দিনরাত। প্রার্থনা করত। মানত করত। ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে এই নরকের মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। যাবেই বা কোথায়? কার কাছে? পাঁচ ছেলেমেয়ের মা রাহেলা কি সেই আগের আদরের মেয়েটি আছে ও বাড়িতে! কবেই ওর শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গেছে। ঠিক বুঝে গিয়েছে রাহেলা- মুক্তি নেই তার এই জগতে। তা বলে মরবার সাহসও তো নেই। এমন বেড়ি পায়ে পড়েছে যে মরণের সাধ্য নেই ডেকে নেয় তাকে। মনে মনে সে এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিল।
আজ এসেছে সেই দিন, তার স্বাধীনতা দিবস। আচার আনুষ্ঠানিকতা শেষে সবাই একে একে বিদায় নিলে নিজেকে অনেকটা সম্রাজ্ঞি মনে হয় রাহেলার। এখন থেকে এই ঘরে সবকিছু তার ইচ্ছায় চলবে। কারও অনুমতি নিতে হবে না দিনরাত। হাঁড়ভাঙা খাটুনি শেষে তিরস্কৃত হতে হবে না অকারণে, যখন তখন।
কোমরে আঁচল গুঁজে হাল ধরেন তিনি সংসারের। তেমন কিছু রেখে যায়নি মানুষটা, তিন কামরার ছোট্ট বাড়িটা ছাড়া। তবু দিন চলে যায়। টানাটানি থাকলেও ছেলেমেয়ে নিয়ে পথে নামতে হয়নি তাকে। বাবা বাড়ির অল্প পাওনা, বড় ছেলের বৃত্তি, আর এক ঘরে ভাড়াটিয়া রেখে খেয়ে না খেয়ে দিন কেটে যায়। তবু খুশির সীমা নেই রাহেলার। ঘরের চাবি এখন তার হাতে। চাবি যে কেবল ঘরের দরোজার তালা খুলতে লাগে তা তো নয়। কখন দরোজা খোলা হবে, কখন বন্ধ হবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা এখন তার।
চল্লিশ বছর পর। রাহেলার ছেলেমেয়েরা অনেক বড় এখন। মানুষ হয়েছে। সবাই বাবা মাও হয়েছে। কেবল একটি ছাড়া। ভালই হল- অন্যদের মতো বড় হলে, মানুষ হলে মায়ের ঘরে কি আর পড়ে থাকতো! অপ্রকৃতস্থ ছেলেকে নিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে মায়ের। অন্য ছেলেমেয়েরা আসে যায়, খোঁজ খবর নেয়। খুব বেশী কিছু চাই না আর।

কুমুর পড়াশোনার মাথা নেই। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেছিল মা ছোটবেলায়। কাজ হয়নি। তের চৌদ্দতে বাবা তাই বিয়ে দিয়ে দেয় মেয়ের। পাত্র তেমন শিক্ষিত নয়। জাত বংশ ভাল; গ্রামের বনেদি গৃহস্থ পরিবারের ছেলে। আয় রোজগারও খারাপ না। আরব দেশে ব্যবসাবাণিজ্য করে। বয়সে কুমুর দুই গুণ হবে। তবে বৌ এর জন্য অনেক আদর। বছরে দু-তিনবার দেশে আসে। বাড়ির সবার জন্য সু্‌টকেস ভরা উপহার। কুমুর জন্য বিশেষ কিছু থাকেই, যা অন্য কেউ দেখে না। বছর চারেক পর আরবের ব্যবসাপাতি গুটিয়ে দেশে চলে আসে সে পুরোপুরিভাবে। নতুন করে শুরু করে কাজ। বাড়িতেই থাকে। দুদুটি ছেলেমেয়ে আসে ঘর আলো করে। কুমুর সুখের সীমা নাই।
অশিক্ষিত বলে এ-বাড়ির কেউ ওকে অসম্মান করে না। কুমুর কথা ছাড়া এক পা-ও নড়েনা কেউ। অবাক হয় কুমু- অনেক উচ্চশক্ষিত মেয়েরও শ্বশুর বাড়িতে এতো সম্মান জোটে না। বরং দিনরাত ঠাণ্ডাযুদ্ধ চলতে থাকে ঐসব পরিবারে। অথচ এ বাড়িতে কুমুর নাম সবার মুখে মুখে। কুমুকে ছাড়া চলেই না। কুমু কিন্তু মোটেও কর্তৃত্বপরায়ণ মেয়ে নয়; ভীষণ শান্ত।
কোলের মেয়েটি বছর পার হল মাত্র। বাবার কোলে চড়ে বসে। সবাই মিলে টেলিভিশন দেখতে দেখতে বিকেলের চা খেতে থাকে। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎই বুকে ব্যথা করে ওঠে মানুষটার। মেয়েকে আস্তে করে কোল থেকে নামিয়ে বুক চেপে ধরে। ডাক্তার ডাকারও সময় দেয়নি। নিঃশব্দে পাড়ি দেয় সে অন্য ভুবনে। কুমুর তখন পঁচিশও হয়নি।
সবাই ধরেই নিয়েছিল- এ আর এমন কি বয়স! আবার বিয়ে করে দ্বিতীয় জীবন শুরু করা যাবে কিছুদিন পার হলে। নিতান্ত সাদাসিধে অশিক্ষিত মেয়ে। রূপবতী, কথাটা সত্যি; বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন নেই। কারও গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারলেই বাঁচোয়া। দোজবরে, ঘাটের মরা একটা হলেই হয়। কে জানত সাদাসিধে অশিক্ষিত বোকা মেয়ের এমন ধনুক ভাঙা পণ!
অল্পশিক্ষিত মানুষটা তাকে তো কেবল ঘর দেয়নি, দিয়েছে বেহেশত। সেই বেহেশতে ফুল ফুটে আছে। সেই বেহেশতের রানী সে। এই বেহেশত ছেড়ে কোথায় যাবে সে? কাছারি ঘরের পাশেই ঘুমিয়ে আছে মানুষটা। ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন বেড়ার ঘেরা দেওয়া উঁচু জায়গাটা কাছে গিয়ে দেখে। কিছু বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে পাতাবাহার গাছ লাগায় ছেলে। কাছে যায় না কুমু। সব দেখে দূর থেকে। দরোজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে।
শাশুড়ি মা আছেন তখনও। অনেক বোঝান কুমুকে- ‘চলে যা এ বাড়ি থেকে, নতুন জীবন শুরু কর, বাচ্চাদের কথা ভাবতে হবে না। ওদের আমি দেখবো, ওপরে আল্লাহ একজন তো আছেনই’। কুমু নির্বিকার। আরও অনেকেই বুদ্ধি দেয় কুমুকে। নিরুত্তর, নির্লিপ্ত কুমু বরাবরের মতো। ছেলেমেয়েরা বড় হতে থাকে। বছর কয় বাদে শাশুড়ি শয্যা নেন ছেলের পাশে। আরও কিছু বছর পর একই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন বড় ভাসুর, যিনি ওদের আগলে রাখতেন বটবৃক্ষের মতো করে। দুই ছেলেকে নিয়ে মায়ের সেই বিছানা বাঁধাই করে দেয় কুমু ইট সিমেন্ট দিয়ে। ছেলের লাগানো পাতাবাহার অনেক বড় হয়ে উঠেছে। ছেলেও দিনে দিনে মাথা তুলছে। মেয়েটিও।
আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা লেগেই আছে। আজ দেবর, কাল ননাশ, পরশু ঝিয়ারী, তরশু ভাসুরপুত্র কেউ না কেউ আসছেই। বাবার বাড়ি যাওয়ার সুযোগও মেলেনা কুমুর। হঠাৎ অনেকদিন পর গেলেও ফিরে আসে সূর্য ডোবার আগে। ছেলেমেয়েদের পড়া থাকে। ঘরে কাজেরও শেষ নেই।
বিয়ের বয়স দশ-এগার হয়েছিল সত্য, তবে সব মিলিয়ে মানুষটার সঙ্গে ঘর করেছিল ও বছর চারেক। মানুষটা চলে গেছে পনের বছর। কুমুর কিন্তু মনে হয় সে পাশেই আছে। দেখছে ওকে।
কুমুর এখনও ভরা সংসার। এক হাতে সামলে উঠতে কষ্ট হয়। ননাশ তাই একটা মেয়ে যোগাড় করে দেয়, দিনরাত থাকার জন্য। সেই মেয়ের আবার পড়ার শখ। কুমু তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। বাড়িতে তাকে পড়াবার জন্য জায়গীর মাস্টারও ঠিক করে। স্কুলের পড়া, ঘরের পড়া সব করে সময় পেলে হাত লাগায় সে গৃহকর্মে, কুমুর সঙ্গে। এসএসসি পাস করে কলেজ ভর্তির অপেক্ষায় আছে। পড়ার চাপ বাড়ছে। নিজের ছেলেমেয়েরা স্কুলের গণ্ডি পার হয়েছে। এখন গৃহকর্মীর পড়ার জন্য দিনরাত বাড়িতে থাকতে হয় কুমুকে, কোথাও যাওয়ার জো নেই। যাবেই বা কোথায়! পাড়া বেড়ানির শখ কোনকালেই ছিল না। ঘর গেরস্থালি সামলে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কাছারির বাগানটার দিকে তাকিয়ে থাকে কুমু। নানান জাতের গাছ গাছালি ছায়া দিয়ে রেখেছে পুরো বাগানটা। সেখানে ঘুমিয়ে আছে ওর ভালোবাসার মানুষ। না, এখনই যেতে চায় না সে। অনেক কাজ বাকি।

সবাই ধরেই নিয়েছিল- এ আর এমন কি বয়স! আবার বিয়ে করে দ্বিতীয় জীবন শুরু করা যাবে কিছুদিন পার হলে। নিতান্ত সাদাসিধে অশিক্ষিত মেয়ে। রূপবতী, কথাটা সত্যি; বুদ্ধিসুদ্ধি তেমন নেই। কারও গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারলেই বাঁচোয়া। দোজবরে, ঘাটের মরা একটা হলেই হয়। কে জানত সাদাসিধে অশিক্ষিত বোকা মেয়ের এমন ধনুক ভাঙা পণ!