আপডেটের সময়ঃ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২২
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার মুখে মিকা আর আমি আমাদের ভাড়া করা ইজি-বাইকে করে বেড়িয়ে গেলাম এগারো-বারো-তের শতকে নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির দেখতে। কয়েক মাইল জুড়ে হাজারো মন্দির ছড়িয়ে থাকলেও, কয়েকটি মন্দির আছে যেগুলো দেখতে মানুষ বেশি ভিড় করে। মিকা ঠিক করল শ্বেযিওন মন্দির থেকে সূর্যাস্ত দেখবে। এটি ছাড়া আর কোন কোন মন্দির দেখব ঠিক না করেই আমরা গন্তব্যে ছুটলাম। নতুন বাগান শহর থেকে পুরান বাগান শহর কয়েক কিলোমিটার দূরে। মিকা খুব আস্তে আস্তে রাস্তার একধার ধরে বাইক চালাতে লাগলো। একপর্যায়ে মনে হল বাই-সাইকেল বুঝি আমাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একটা লম্বা রাস্তার দু’পাশে বেশিরভাগ মন্দির ও মঠ নির্মিত হয়েছে। অসংখ্য মঠ পার হয়ে আমরা এগিয়ে থাকলাম। একটা পর্যটকের গাড়ি অনুসরণ করে গিয়ে থামলাম গাওদাওপালিন মন্দিরের সামনে যেটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১২০৩ সালে রাজা নরপতিশিথুর আমলে এবং শেষ হয়েছিল ১২২৭ সালে তার উত্তরসূরি রাজা হতিলমিনলোর আমলে। দুই চেম্বার বিশিষ্ট এই মন্দিরের নকশা করা হয়েছিল মূলত ধ্যান করার জন্য।
মন্দিরের সাদা রঙের উপর শ্যাওলা জমে একটা কালচে রঙ ধারণ করেছে। উপরের চেম্বারে বৌদ্ধের সটান প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছে। ভক্তেরা ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে বৌদ্ধের সামনের অংশটুকু। মন্দিরের সামনে সাজানো বাগান। নরপতিশিথুর যখন তার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে তখন সেটা হয়েছিল স্থানীয় নিয়ম অনুযায়ী। নিয়ম হল রাজার পাঁচ ছেলে একটা বড় ছাতাকে ঘিরে দাঁড়াতে হবে, তারপর ছাতাকে লাট্টুর মত ঘুরিয়ে দেয়া হবে। ছাতা ঘূর্ণন বন্ধ করে যে ছেলের দিকে তার সূচালো মাথা তাক করবে, সেই হবে পরবর্তী রাজা। এই নিয়মের কথা জেনে চমৎকৃত হলাম। এই নিয়মে নরপতিশিথুর পরে রাজা হলেন হতিলমিনলো। আর যেই জায়গায় এই রাজা নির্বাচন হল ছাতা দিয়ে, সেখানে ১২১৮ সালে নির্মাণ করা হল হতিলমিনলো বৌদ্ধ মন্দির। মন্দিরের ভেতরে বিশা বৌদ্ধের বিশাল এক ধ্যানরত পাথরের প্রতিমা। দেয়ালে আঁকা আছে বৌদ্ধের জীবন কথা যা জাকাতা শিল্প বলে পরিচিত।
আনন্দ মন্দির, নাম শুনে হিন্দু মন্দিরের মতো লাগে, এর নকশাতেও আছে উত্তরভারতের নকশা এবং স্থাপত্যের ছাপ। এই মন্দিরের নির্মাণকাল ১০৯০ থেকে ১১০৫। এই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা সব মন্দিরের মধ্যে এই মন্দির নজর কাড়বেই পর্যটকের। এর সামনে পর্যটকের গাড়ির ভিড় আবার বিভিন্ন জিনিসের পশরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। নানারকম বৌদ্ধের ছোট ছোট প্রতিমা, মাটির ভান্ত আবার কাপড়-চোপড় সাজিয়েও বসেছে অনেকে। মিকা ডাব দেখে মোটামুটি একটা ছুট দিল কেনার জন্য। ডাবের জল খেয়ে আমরা মন্দিরের দিকে গেলাম। বাইরে সাদা রঙ কালো হয়ে এসেছে কিছুটা। মন্দিরের চূড়া সোনালি রঙয়ের। মন্দিরের নয়শ বছর পূর্তিতে এর চূড়াকে সোনালি রঙে রাঙানো হয়েছে। এই মন্দির নিয়ে গল্প প্রচলিত আছে যে, রাজা কায়ানযিত্থার আমলে ভারত থেকে কয়েকজন বৌদ্ধভিক্ষু পাগান রাজ্যে আসেন রাজার আমন্ত্রণে। তারা রাজাকে হিমালয়ের এক গুহার ভেতরের মন্দিরের কথা বলেন এবং রাজাকে দিব্যদৃষ্টিতে হিমালয়ের সেই মন্দির এবং তুষারে ঢাকা মন্দিরের চারপাশ দেখান। সেই মন্দিরের কথা শুনে এবং দিব্যদৃষ্টিতে দেখে রাজা সিদ্ধান্ত নেন তিনি এই মন্দির নির্মাণ করবেন। পনেরো বছর লাগিয়ে নির্মাণ করা হয়। নির্মাণ শেষে নাকি রাজা মন্দিরের সাথে যুক্ত সকল স্থপতিকে মেরে ফেলেন যাতে কেউ এই মন্দিরের অনুকরণে আর কোন মন্দির করতে না পারেন। মন্দিরের ভেতরে চারদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন চার বৌদ্ধ।
এরপর আমরা গেলাম শ্বেযিওন মন্দিরে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো এবং বড় মন্দির এটি। কথিত আছে রাজা আনাওরাথা যিনি বার্মার সকল অঞ্চলকে এক করে আধুনিক বার্মা গড়ে তুলেছিলেন এবং বাগান তথাকথিত পাগান শহরকে রাজধানী করেছিলেন, তিনি বৌদ্ধধর্মের থেরাবাদি ধারায় দীক্ষিত হওয়ার পর এই অঞ্চলে মন্দির নির্মাণের সূচনা করেন এই মন্দিরটির মাধ্যমে। তার সময়ে মন্দিরে সোনার প্রলেপ দেয়া ছিল। ইতালির পর্যটক মার্কো পোলোর লেখাতেও এই মন্দিরের কথা বলা হয়েছে বলে বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ আছে। থেরাবাদ এর বাংলা করা হয়েছে প্রবীণদের ভাষ্য। বস্তুবাদী জাগতিক সকল মোহ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যাক্তির অন্তর্গত জগতের সন্ধান এবং আলোকপ্রাপ্তির সাধনা করা থেরাবাদি বৌদ্ধধর্মের মূল বিষয়। বিশাল সোনালি রঙের ঢোলের মতো মন্দিরটিকে ঘিরে আছে আর ছোট ছোট কয়েকটি স্থাপনা। মন্দিরের প্রবেশমুখে আছে হিন্দু পুরাণের মকর দেবতা। মকর হল স্বর্গদ্বারের পাহারাদার। রাজা আনাওরাথা এই মন্দিরের স্থাপত্যে স্থানীয় পূজিত আত্মারূপি দেবতা নাতদের প্রতিমাকেও রেখেছেন। এই মন্দির তৎকালীন স্থানীয় বিশ্বাসকে যেমন সম্মান করেছে, আবার নতুন বিশ্বাসকেও বরণ করে নিয়েছে। জাগতিক বিচারে মূল্যবান স্বর্ণের ব্যবহার করেছিলেন জাগতিক মোহমুক্তির সন্ধানস্থানে। আমরা তিনতলা মন্দিরের সিঁড়ি বাইতে লাগলাম। মিকাকে মন্দিরের দেয়ালে বসেই সূর্যাস্ত দেখতে হবে, ওর গাইড বইয়ে সেইটাই লেখা আছে। ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য জুতসই জায়গা দখল করার চেষ্টা করে যখন একপ্রকার ব্যর্থ হবার পথে, তখন দুই পশ্চিমা পর্যটক অনুগ্রহপূর্বক বসার জায়গা দিল। আমি আবার এমন দেয়ালের ধারে বসতে পারি না। আমার এক্রোফোবিয়া আছে। যার ফলে উঁচু জায়গা থেকে আমি নিচে তাকাতে পারিনা। এমন দেয়ালের ধারে দাঁড়ালে বা বসলে মনে হয় অভিকর্ষজ ত্বরণ চুম্বকের মত আমাকে টানে। আমি পিছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশে হালকা কুয়াশামত, তাই অস্তগামী সূর্যের তেমন রঙ খুলল না। ২০১৭ সালের বার্মার ক্যালেন্ডারের শেষ সূর্যাস্ত কেমন মলিন দেখাল। ২০১৯ সালে বাগানের মন্দিরের উপরে ওঠা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেবল বাইরে থেকে দেখা যায়। তাই এখন আর এই মন্দিরের উপর থেকে কেউ সূর্যাস্ত দেখতে পারবে না।
সূর্য অস্ত গেলেও এখানে ঝুপ করে অন্ধকার নামেনি। মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা মূল রাস্তায় না থেকে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। যেতে যেতে একসময় টের পেলাম আমরা মূল পর্যটক এলাকা থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি। চারদিকে আমরা ছাড়া আর কোনো পর্যটক বা স্থানীয় মানুষ নেই। কেমন ভয়ভয় করতে লাগলো। বাইক ঘুরিয়ে জোরে চালানো শুরু করল। কোন পথে যাচ্ছি কিছুই জানি না। এলোমেলো সরু-সরু পথ ধরে যেতে-যেতে একটা মন্দিরের দেখা পেলাম। মোবাইলের ছবির সাথে মিলিয়ে জানলাম এই মন্দিরের নাম ধাম্মায়ানগ্যি মন্দির। একতলা এই বিশাল ট্যারাকোটা মন্দির বানিয়েছে রাজা নারাথু ১১৭০ সালে। বলা হয় নিজের বাবা ও ভাইকে হত্যা করে তিনি ক্ষমতায় আসেন। হয়তো নিজের কৃতকর্মের পাপ লাঘবের জন্য এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এর কাজ এতই নিখুঁত যে মানুষ বলে কোন কাজ মনমতো না হলে নারাথু নাকি শ্রমিককে হয় মেরে ফেলতেন অথবা তার হাত কেটে দিতেন। মন্দিরের ভেতরে কিছু কিছু জায়গায় নির্মাণ সামগ্রীর আবর্জনা রাখা আছে। গল্প আছে নির্মাণ শ্রমিকেরা রাজার মৃত্যুর পর তার প্রতি তাদের ঘৃণা প্রকাশ করতে এভাবে ভাঙ্গা ইট সুরকি ফেলে রেখেছিল, আবার কারো-কারো মতে রাজা নারাথুর প্রেতাত্মাকে বন্দি করে রাখার জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই রাজার মৃত্যু নিয়েও আছে নানা। কেউ বলে রাজা নারাথুর এক স্ত্রী ছিলেন ভারতের এক রাজকন্যা, নারাথু তাকে হত্যা করেছিল, তারপর সেই রাজকন্যার ভাই লোক পাঠিয়ে রাজা নারাথুকে হত্যা করে, আবার কেউ বলে শ্রীলংকা থেকে গুপ্তচর এসে তাকে হত্যা করে, কোন কোন গল্প বলে রাজা নিজেই নিজেকে হত্যা করেছিলেন। সে যাই হোক, আমরা অন্ধকার নেমে আসতে আসতে ফিরতে থাকি।
চারদিকে আমরা ছাড়া আর কোনো পর্যটক বা স্থানীয় মানুষ নেই। কেমন ভয়ভয় করতে লাগলো। বাইক ঘুরিয়ে জোরে চালানো শুরু করল। কোন পথে যাচ্ছি কিছুই জানি না। এলোমেলো সরু-সরু পথ ধরে যেতে-যেতে একটা মন্দিরের দেখা পেলাম। মোবাইলের ছবির সাথে মিলিয়ে জানলাম এই মন্দিরের নাম ধাম্মায়ানগ্যি মন্দির।
লেখকঃ রূপা দত্ত।