রফিক আহামদ: স্রোতের বিপরীতে চলা এক সমাজসেবক


এখন চট্টগ্রাম ডেস্ক।

আপডেটের সময়ঃ জুন ১৭, ২০২২

মুহাম্মদ মনির হোসাইন

প্রথাগত গন্ডির বাইরে গিয়ে একজন মানুষ কখনো কখনো হয়ে উঠেন আমজনতার নিকট বটবৃক্ষ; কিংবা সমাজের অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সামনে উঠে আসার ভরসাস্থল। যিনি দেশকে ভালোবাসেন দেশের মানুষকে ভালবাসেন, ভালোবাসেন মানুষের অধিকারকে এবং প্রতিষ্ঠা করতে চান মানব মর্যাদাকে। মুক্তচিন্তার অধিকারী হয়ে, স্রোতের মাঝে গা না ভাসিয়ে সমাজকে দেখান আলোর পথ। নানা সমস্যায় জর্জরিত একটি দেশের মানুষকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অধিকারের আলো ছড়িয়ে দিতে কখনো কুন্ঠাবোধ করেন না এমন ব্যক্তিরাই আমাদের দেশের সম্পদ। এবং তারাই আমাদের সমাজের জন্য অনুসরনীয়। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তখনই ফুটে উঠে যখন একজন মানুষ অন্য মানুষের জন্য তার মনুষত্ব্যবোধ প্রকাশ করে। মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে। মানুষের মুক্তি আসে তখনই, যখন সমাজে একজন মানুষ হিসেবে তার মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্য সমাজসেবীরা কাজ করে থাকে। যেসব সমস্যা সমাজে বসবাসরত মানুষ সমাধান করতে পারে না, সেসব সমস্যা সমাজসেবীরা দূর করতে সাহায্য করে। এতে সমাজ সমস্যামুক্ত হয়। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি দেখে এগিয়ে আসেন এসব মহতী ব্যক্তিরা।

উল্লেখ করছি, চট্টগ্রামের একজন কৃতি ও বরেন্য সমাজকর্মী রফিক আহামদ এর কথা। যিনি একাধারে শিক্ষার প্রসার, সমাজ সংস্কারক, উন্নয়নকর্মী, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য লড়ে যাওয়া এক নিরলস নিবেদিত প্রাণ। আলহাজ্ব রফিক আহামদ। একজন উন্নয়নকর্মী। চট্টগ্রামের স্বনামধণ্য বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ‘মমতা’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বর্তমান প্রধান নির্বাহী। চট্টগ্রামের মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, দারিদ্র পিড়ীত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর।

আলহাজ্ব রফিক আহামদ: বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বাংলাবাজার ঘাট সংলগ্ন বড়বাড়িত জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৯ সনের ৩১ শে ডিসেম্বর। পিতা বজল আহমদ ও মাতা সবুরা খাতুনের ঘরে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি আভিজাত্য আর ধনসম্পদে পরিপূর্ণ পরিবেশে বড় হযে উঠলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সাধারন মানুষ হিসেবে। তাঁর পিতা জীবন সংগ্রামের কারনে খুব বেশি পড়াশুনা করতে না পারলেও উচ্চ শিক্ষিত করার পিতার লালিত স্বপ্ন পূরণ করেছেন অত্র অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে প্রথম স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে। তাঁর পিতা মরহুম বজল আহামদ স্বভাবজাতই একজন সমাজসেবক ও মানবতা প্রেমী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে রফিক আহামদ এর ধমনীতেও প্রবাহমান ছিলো সমাজসেবার বিষয়টি। ধনসম্পদ আর আর্থিক লোভ লালসা তাকে মোহিত করতে পারে নি। আভিজাত্যর সিঁড়ির উপরে থেকেই নয় বরং তিনি নিচে নেমে এসে মনুষ্যত্ববোধ থেকে সাধারন মানুষের সেবা করেছেন মানুষের সাথে মিশে যেতে পেরেছেন রফিক। পিতার ধন সম্পদ ও আভিজাত্যকে একপাশে রেখে সমাজসেবায় নিজেকে সঁপে দেন রফিক। তিনি তাঁর জীবনব্যাপী যেভাবে পিতার আদর্শকে বুকে ধারন করে মানুষের কল্যানে কাজ করেছেন, বিনিময়ে পেয়েছেন অজস্র মানুষের আস্থা, বিশ্বাস আর ভালোবাসা। সমাজসেবার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ সমাজসেবক’ এর মর্যাদাসহ অসংখ্য সম্মাননা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও। ব্যক্তি রফিক আহমদের চারিত্রিক গুনাবলীর প্রভাব পড়েছে তাঁর পেশাগত জীবনেও। সকল বাঁধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে সকলকে তিনি একই ছাতার নিচে আবদ্ধ করে সাম্যবাদের নীতিতেই কাজ করে চলেছেন অনবরত। সমাজে রফিক আহামদ এর অবদানের একাংশ উল্লেখ করতে গিয়ে দেখা যায়।

স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষত: মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী রফিক আহামদ এর নেতৃত্বে মমতা’র প্রতিষ্ঠিত নগর মাতৃসদন হাসপাতাল সমুহের মাধ্যমে ১ লক্ষাধিক মায়ের সিজারিয়ান ও নরমাল ডেলিভারী সম্পন্ন করিয়েছেন অত্যন্ত নামমাত্র মূল্যে। যারা কোন ফি দিতে পারেন নি, মমতা ফেরায়নি তাদেরও। মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবায় অনবদ্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ সরকারের নিকট এ পর্যন্ত ১৪ বার জাতীয় পুরষ্কার লাভ করে তারই নেতৃত্বাধীন সংস্থা মমতা।

স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের বিষয়টি গুরুত্ব দেবার পাশাপাশি সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন রফিক আহামদ। এরই ফলশ্রুতিতে মমতা সঞ্চয় ও ঋণদান কর্মসূচির আওতায় জামানত দেবার ক্ষমতা নেই অথচ অর্থনৈতিকভাবে উদ্যোক্তা হয়ে সমাজের ভুমিকা রাখার প্রতি আগ্রহী এমন উদ্যোমী ব্যক্তিদের মাঝে ঋন সুবিধা প্রদান করছেন। এর পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উদ্যোক্তা সৃষ্টির উপর গুরুত্বরোপ করে শহর ও গ্রাম পর্যায়ে আর্থিকভাবে অনগ্রসরদেরকে অর্থনৈতিকভাবে উঠে দাঁড় করানোর জন্য ঋন বিতরণ করেছেন ১ লক্ষেরও বেশি মানুষের নিকট, যার অধিকাংশই এককালে সমাজের পিছিয়ে থাকা ও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল নারী সদস্য। এদের অধিকাংশই আজ সমাজে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা আনতে পেরেছেন এবং সমাজে সম্মানের সাথে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন; একই সাথে স্বচ্ছলতার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যদেরকেও।

মার্চ ২০২২ এর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বর্তমানে চট্টগ্রাম, কক্সাবাজার, বান্দরবান, ফেনী ও কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত মোট ৮৩টি শাখার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে মমতা’র ঋণস্থিতি রয়েছে ৪২৪ কোটিরও বেশি। যা কাজে আসছে শহর ও গ্রাম পর্যায়ের অসংখ্য উদ্যোক্তা সৃষ্টিসহ অর্থনীতির চাকা সচল রাখার কাজে। যার ফলে সিটি ফাউন্ডেশন এর নিকট হতে সারাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ক্ষুদ্রঋন সংস্থা হিসেবে ২০১৭ সালে ‘বেস্ট এমএফআই অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে মমতা।

এছাড়া নারী ও শিশু অধিকার রক্ষা, গার্মেন্টস নারী শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, প্রবীন জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বল্প বা আয়হীন মানুষের সম্পদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, চট্টগ্রামের লাল গরু সংরক্ষনে, ভিক্ষুক পূনর্বাসন, গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থাকরণে সহায়তা, নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে হাতে কলমে প্রশিক্ষন, নিম্ন আয়ের শ্রমীকদের সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণে মমতা স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা, বস্তির বা কমিউিনিটি পর্যায়ে শিশু মেধা বিকাশে চাইল্ড স্পেস সেন্টার, কৃষি, মৎস এবং প্রানিসম্পদ উন্নয়নে, পুষ্টির চাহিদা পূরনে মমতা ডেইরী ফার্ম প্রতিষ্ঠা সহ বহু ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন। মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের মনোবাসনায় শুরু করা রফিক আহামদ নিজ প্রতিষ্ঠিত সংস্থায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।

ছাত্র আলহাজ্ব রফিক আহামদ এর সম্পর্কে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, ‘মানুষের জীবনের স্বার্থকতা তখনই ফুটে উঠে যখন মানুষের কল্যানে অবদান রাখতে পারে, আমাদের সমাজের অনেকের জন্যই রফিক অনুসরনীয়; এটা ভাবতেই ভালো লাগে রফিক আহামদ এর মতো মানবহিতৈষী ব্যক্তি একসময় আমার ছাত্র ছিলেন। তিনি সাধারন মানুষের জন্য যেসব অবদান রেখে চলেছেন, তা অবশ্যই তাঁকে মানুষের মনে আজীবন বাঁচিয়ে রাখবে।’ একই মত পোষন করেন শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান। তিনিও রফিক আহামদ এর একজন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মু. সিকান্দার খান বলেন- ‘আমাদের সমাজ সুন্দর হয়ে উঠে তখনই যখন সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে সেগুলোকে সমাধানের লক্ষ্যে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেন। মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রফিক ও তার নেতৃত্বাধীন সংস্থা মমতা যেভাবে কাজ করছে এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। রফিক যে কাজটি করে যাচ্ছেন তা আমাদের সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি তার শিক্ষক হিসেবে অবশ্যই তার কাজে গর্ববোধ করি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতকোত্তর শেষেই সমাজের মানুষের জন্য কাজ করার মানসে নেমে পড়েন তিনি। রফিক আহামদ ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন স্বনামধন্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক, উন্নয়নমূখী কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তাঁর সম্পর্কে সমাজের তারই ঘনিষ্টজনরা সহ সমাজের বিশিষ্ট্য ব্যক্তিরা মনে করেন- কেবল সমাজসেবক হিসেবেই নয়, শিক্ষা, সাহিত্যে, সাংস্কৃতি, ক্রীড়া, ধর্মীয় ও রাজনীতি সহ বিভিন্ন দিকেও নি:স্বার্থভাবে মানুষের কল্যানে পৃষ্টপোষক হিসেবে ভুমিকা পালন করে আসছেন তিনি। চট্টগ্রামের একটি প্রভাবশালী ও বনেদি শিল্পপতির পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ব্যক্তিজীবনে তিনি ‘মাটির মানুষ’ ও ‘ভালোবাসার মানুষ’ হিসেবে সকলের মাঝে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রফিক আহামদ বলেন, ‘সমাজের জন্য কাজ করার প্রচেষ্ঠা আমি আমার পিতার আদর্শেই অনুপ্রানিত হয়েছি। জানি না এ কাজে কতোটা সফল হতে পেরেছি। তবে এটা ঠিক যে, আজকের এ পর্যায়ে আসতে আমাকে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হতে হয়েছে। আমার পথচলায় স্ত্রী শাহাজাদী বেগম নেপথ্যে থেকে আমার অনেক কন্টাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছি। সমাজের জন্য কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় হয়তো পরিবারকে যথাযথভাবে সময় দিতে পারি নি। এ নিয়ে অবশ্য শাহাজাদীর কোন অনুযোগও ছিলো না। কারন তিনি জানতেন, আমি এক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি এবং সেটা সমাজের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য।”##

লেখক- সাংবাদিক

ইমেইল:  mhniloy.cj@gmail.com